একটি বিদেশি ছবি দেখে: স্বদেশের জন্য চোখ ভিজে আসে, চোখ ভেসে যায় !!


কিছুদিন আগে একটা ইংরেজি ছবি দেখেছিলাম। এইচ.বি.ও চ্যানেলে। নাম দ্য সোলোইস্ট। একজন ধ্রæপদি চেলো বাদকের এবং লস এঞ্জেলেস টাইমস্- এর এক কলামিস্টের সম্পর্কের ওপরে নির্মীত এক অসাধারন ছবি। স্টীভ লোপেজ লস এঞ্জেলেস টাইমস্-এর কলামিস্ট। আর ন্যাথ্নিয়েল আয়ার্স এক আমেরিকান-আফ্রিকান চেলো বাদক। তার অবস্থান লস এঞ্জেলেস-এর স্কিড্ রো তে। এই স্থানটিতে অজ¯্র গৃহহীনদের বাস। ন্যাথ্নিয়েল কে হঠাৎই আবিষ্কার করে স্টীভ লোপেজ। সে লস এঞ্জেলেসের একটি ব্যস্ত রাস্তার ফুটপাথের একটি কোণায় দাঁড়িয়ে নিজ মনে বেহালা বাজাচ্ছিল। এরপর বিভিন্ন জায়গায়, বিভিন্ন ফুটপাতে, পার্কের কোণে স্টীভ, ন্যাথ্নিয়েলকে দেখতে পায়। মাঝে মধ্যেই দাঁড়িয়ে তার বাজনা শোনে। সেই বাজনা শুনে তার প্রত্যয় জন্মায় যে এ কোন সাধারন ভিখেরী বাদক নয়। কেন যেন মনে হয় এর মধ্যে রয়েছে সংগীতের শিক্ষা এবং অনুশীলন।

আস্তে, আস্তে বিভিন্নভাবে কলাম লেখক স্টীভ, ন্যাথ্নিয়েল আয়ার্সের বেশ কাছাকাছি চলে আসে। এক প্রায় অবিচ্ছেদ্য বন্ধুত্বের সৃষ্টি হয় তাদের মধ্যে। স্টীভ জানতে পারে ন্যাথ্নিয়েল এর কাছে বেথহোফেন-ই হচ্ছে ঈশ্বর। বেথহোফেন এর কথা বলতে, বলতে ন্যাথ্নিয়েল এর চোখ দু’টো জ্বল, জ্বল করে উঠে। মুখটা উদ্ভাসিত হয়ে যায় আলোয়। একসময়ে চোখ ভরে আসে টলটলে জল। স্টীভ আগ্রহী হয় এই ভবঘুরে বাদকটিকে জানতে। সে জানতে পায় যে ন্যাথ্নিয়েল বাল্যকাল থেকে এক দূর্মর আকর্ষণে প্রতিচ্যীয় সংগীতের দিকে ধাবিত হয়। বাচ্চা বয়সের ছেলেটি একটি বিশাল বড় চেলো হাতে নিয়ে সংগীত ভবনের দিকে ছোটে। তারপর এক ভূতে পাওয়া মানুষের মত চেলোর ওপরে ছড় টেনে বেথহোফেন-এর সিম্ফনী’র এক মায়াজাল সৃষ্টি করে যেন। তারপর ক্রমে সে বড় হয়ে উঠে এক ছন্নছাড়া পরিবেশে। কোন স্বীকৃতি পায়না তার এই কালজয়ী প্রতিভা। তার অতিপ্রিয় চেলোটি-ও কোথায় চলে যায় কে জানে ?
ন্যাথ্নিয়েল-এর কোন গল্প নেই, অথবা সে জানে না আদৌ কোন গল্প আছে কিনা? সে দিব্যি খুশি রাস্তায় ভবঘুরে বাদক হিসেবে আজ এখানে, কাল ওখানে দাঁড়িয়ে তার সংগীত সাধনা করতে। স্টীভ প্রাণ উজাড় করে একটি কলাম লেখে ন্যাথ্নিয়েল- এর ওপর।। স্টীভ এর প্রতিবেদনে সাড়া পরে যায় ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যে। বিশেষ সম্মানে ভূষিত হয় সে প্রশাসন দ্বারা ভবঘুরে এক বাদককে নিয়ে লেখার জন্য। আমরা জানতে পাই যে এক লস এঞ্জেলেস শহরে ৯০ হাজার গৃহহীন মানুষ বাস করে। আমাদের চোখ ক্যামেরার লেন্স হয়ে ধোঁয়াশা পরিবৃত এই হাজার, হাজার গৃহহীনদের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায় আস্তে, আস্তে রাতের গভীরে। আমরা দেখতে পাই ঐ সুদূরে ন্যাথ্নিয়েল একা দাঁড়িয়ে বাজিয়ে চলেছে তার যাদুর বেহালা।

ছবিটি এই খানেই শেষ নয়। আরও অনেক ঘটনা রয়েছে এর পরে। স্টীভ চায় ন্যাথ্নিয়েল-এর পূনর্বাসন। কোন এক ভবঘুরে আশ্রমে। কিন্তু ন্যাথ্নিয়েল তো প্রকোষ্ঠ বন্দী হতে চায় না ? তার জায়গা তো খোলা রাস্তা , উন্মুক্ত আকাশ আর অসংখ্য গাড়ীর প্রাণ কাঁপানো শব্দ। আমরা যদি ধরে নেই যে গল্পটির শেষ এখানেই তাহলেই বা মন্দ কি? আমি তো তখন দিব্যি পায়ে হেঁটে চোখ দু’টোকে কেবল সম্বল করে গভীর রাতের নিস্বব্ধতাকে স্বাক্ষী রেখে এগিয়ে চলেছি আমার এই প্রিয় শহর ঢাকার রাস্তায়। আমি দেখছি কারওয়ান বাজারে, তেজগাঁও-এ, কমলাপুরে কিংবা সদরঘাটে অজ¯্র মানুষ দিন শেষে এক মানবেতর অবস্থায় পরম সুখে নিদ্রামগ্ন। তাদের আহার, সংসার, রমন, তো খোলা আকাশের নীচে এই রাস্তাতেই? আমাদের প্রতিবেদকদের মধ্যে আছে কি কোন স্টীভ লোপেজ যে তার সকল স্পর্শকাতরতা নিয়ে আমাদের নিজস্ব ন্যাথ্নিয়েল কে খোঁজা শুরু করবে আমাদের এই প্রাণ প্রিয় শহরে? দিনের আলোয় অথবা গভীর যামিনীতে? আমাদের সড়কে কিংবা গলি ঘুঁজিতে লুকিয়ে আছে কি কোন ন্যাথ্নিয়েল এন্থনি আয়ার্স যে তার সংগীতে নিজেকে আকন্ঠ ডুবিয়ে দেয়? যেন বা খুঁজে পায় ঈশ্বরকেই সেই সংগীতে?
আমার বুক ভাসিয়ে দিয়ে দরদর করে অশ্রæ নেমে আসে মনে হয় আমার এই শহরে আছে কি সেই সংগীতজ্ঞ লুকিয়ে ঐ ভবঘুরেদের মাঝে যে একতারায় তোলে সঞ্জীবনী সুর? ‘দ্য সোলোইস্ট’ আমাকে মনে করিয়ে দেয় লালন শাঁই, মনমোহন দত্ত, ফকীর আফতাব উদ্দীন, আলাউদ্দীন খাঁ, আয়াত আলী আরও কত জানা-অজানা নাম। এঁদের কেউ কি লুকিয়ে আছে গভীর রাতে ঢাকার রাস্তায় নিদ্রামগ্ন ঐ অজস্্র মানুষের মাঝে? ঠিক যেমন একজন ন্যাথ্নিয়েল আয়ার্সকে আবিষ্কার করার জন্য একজন স্টীভ লোপেজ কে দরকার তেমনি আমাদের প্রয়োজন একজন তী²দৃষ্টি সম্পন্ন , ভালোবাসার বোধ সম্পন্ন এক প্রতিবেদককে যে তুলে ধরবে আমাদের নিজস্ব ন্যাথ্নিয়েলের কথা।

আমাদেরই এই সমাজে ছিল তো সবই! সংবেদনশীলতা ছিল, স্পর্শকাতরতা ছিল, ছিল বোধ, ছিল ভালোবাসা, আমাদের আবহমান কালের শুদ্ধ সংগীতের ঐতিহ্যকে ভাগাড়ে নিক্ষেপ করেছি তো আমরাই। আর আমাদের সাথে হাত মিলিয়েছে আমাদের গণমাধ্যম! যাদের কৃপায় আমাদের শিল্পকর্ম লঘু হতে, হতে, হতে এমন এক নিñিদ্র অন্ধকার গহŸরে পতিত হয়েছে যে আমরা আর উন্নত সংস্কৃতির মানুষ হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছি না। ক্রমাগত বাঁদর নাচ নেচে চলেছি অন্যের অনুকরণে, নিজের সকল গৌরবের অতীতকে বেমালুম ভুলে। আর তাতে ইন্ধন জুগিয়ে চলেছে আমাদের মাধ্যমগুলো বিকারহীন ভাবে। এইখান থেকে বেরিয়ে আসতে হলে আমাদের আবহমান সংস্কৃতির ঐতিহ্যের গভীরে আমাদেকে প্রবেশ করতে হবে। খুঁজে বের করতে হবে যেখানে মহর্ষী মহমোহন দত্তের অমৃত বাণীকে মহোত্তর করে তুলেছে ওস্তাদ আলাউদ্দীন খানের অগ্রজ ফকীর আফতাব উদ্দীন কর্তৃক সংযোজিত ললিত, কেদার অথবা মেঘমল্লার রাগ। তিনি-ই ছন্দবদ্ধ করেছেন সেই সংগীতকে একতাল, ঝাপতাল কিংবা সুর ফাকতালে। এই সুর এখনও আমাদের হৃদয় মোথিত করে। গাঁয়ের কৃষক গেয়ে চলে কোন পড়ন্ত বিকেলে ক্ষেতের আগাছা বাছতে, বাছতে।
আমি নিশ্চিত যে একটি সংবেদনশীল গণমাধ্যম এবং একগুচ্ছ শিক্ষিত, অনুসন্ধিৎসু প্রতিবেদক হাতে হাত মেলালে আমাদের রাজপথে কিংবা আলপথে, খালে-বিলে কিংবা নদীতে বিচরণরত এই মানুষগুলোকে সর্বসমক্ষে এনে নিজেদের কে ধন্য করা যাবে।

রবীন্দ্রনাথঃ শাশ্বত সখা আমাদের

কোলকাতা, ১৯৭১ সালের এক বিকেল। প্রয়াত রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ওয়াহিদুল হক এবং সন্জীদা খাতুনের নেতৃত্বে সংগঠিত মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা ঐদিন অপরাহ্নে শরণার্থী শিবিরে তাদের বিখ্যাত রূপান্তরের গান অনুষ্ঠানটি আয়োজন করেছিল। এই শিল্পী সংস্থা বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী এলাকায় শরণার্থী শিবির এবং মুক্তিযোদ্ধা শিবিরে নানা ধরনের দেশ-গান গেয়ে দীর্ঘ সাত মাস সকলকে অনুপ্রাণিত করেছে। আমি জানতাম যে ওয়াহিদ ভাই (ওয়াহিদুল হক) এবং মিনু আপা (সন্্জীদা খাতুন) কতগুলো অসাধারণ দেশাত্মবোধক গান শিখিয়েছিলেন এই সংস্থার শিল্পীদেরকে। সেই বিকেলে উন্মুখ হয়ে ছিলাম গানগুলো শোনার জন্য। কিন্তু গান শুরু হতেই চমকে উঠলাম। মনে হলো এই গানটি তো আমি এর আগে কোনদিন শুনিনি! স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছিল গানটি ছিল রবীন্দ্রনাথের। কিন্তু এর কথা ও সুর ছিল আমার অজানা। এর পরে আরও অনেকবার গানটি শুনেছি এবং ঐ গানের সুর আর কথা, আমি হেন সঙ্গীত বিবর্জিত ব্যক্তিরও কানে সর্বক্ষণ বাজে।

‘‘দেশে দেশে ভ্রমি তব দুখ গান গাহিয়ে
নগরে প্রান্তরে বনে বনে।
অশ্রæ ঝরে দু নয়নে, পাষাণ হৃদয় কাঁদে সে কাহিনী শুনিয়ে।”

গানটি শুরু হবার সাথে সাথে হৃদয় মথিত করে অশ্রæধারা নেমে এলো আমার দুচোখে। ভাবলাম আর কতদিন, মাগো, তোমার স্বাধীনতার জন্য দেশে দেশে, বনে প্রান্তরে ঘুরে বেড়াতে হবে আমাদের? তারপর ঐ গানেরই ভাষায় ঃ

‘‘জ্বলিয়া উঠে অযুত প্রাণ, এক সাথে মিলি এক গান গায়
নয়নে অনল ভায়-শূন্য কাঁপে অভ্রভেদী বজ্রনির্ঘোষে!
ভয়ে সবে নীরবে চাহিয়ে”।

আবার থমকে গেলাম। আবার আশা জাগে বুকে। যুদ্ধে তো নেমেছি, বজ্র নির্ঘোষে শ্লোগান দিয়েছি ‘‘জয় বাংলা”। স্বাধীনতা অর্জনের পরেই থামবো এবার। এই গানের শেষ চরণে রবীন্দ্রনাথ বলছেনঃ

‘‘ভাই বন্ধু তোমা বিনা আর মোর কেহ নাই
তুমি পিতা, তুমি মাতা, তুমি মোর সকলই
তোমারি দুঃখে কাঁদিব মাতা, তোমারি দুঃখে কাঁদাব
তোমারি তরে রেখেছি প্রাণ, তোমারি তরে ত্যাজিব
সকল দুঃখ সহিব সুখে
তোমারি মুখ চাহিয়ে”।

গানটি শেষ হলো। অন্য কোন গান ধরল শিল্পীরা সব। আমার চোখ দিয়ে তখনও ঝরছে অঝোর ধারায় অশ্রæ। ভাবলাম, কত বড় মাপের স্বপ্নদ্রষ্টা হলে পরে এমন একটি সর্বযুগীয় প্রাসঙ্গিক গান নির্মান করতে পারেন একজন ¯্রষ্টা? ঐদিনের অনেক পরে স্বাধীন দেশে ফিরে এসে বই পড়ে জানলাম যে, রবীন্দ্রনাথ এই গানটি লিখেছিলেন কুড়ি বছর বয়সে। অর্থ্যাৎ ১৯৭১-এ এই গানটির বয়স হয়েছে ৯০ বছর। এই সুদীর্ঘ ৯০ বছরেও গানটির প্রাসঙ্গিকতা একটুও ¤øান হয়নি। আমার মনে হয় বিশ্বের সকল মুক্তিকামী মানুষের জন্য হাজার বছর ধরে অ¤øান থাকবে এই গানের আবেদন। এইভাবেই, এমন অমর কাব্যগাথার মধ্য দিয়েই একজন ¯্রষ্টা চিরায়ত হয়ে যান।

আমি আমার সীমিত জ্ঞান এবং বিদ্যা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে আমাদের সমাজে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য কর্মের কিংবা সঙ্গীতের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার চেষ্টা করেছি। আমি রবীন্দ্রনাথের কোন গভীর, গম্ভীর কবিতায় প্রবেশ না করে আজকের এই আলোচনার জন্য তুলে দিই দু-একটি নিদর্শন, যা আমাদের সমাজের বিভিন্ন দিক নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ভাবনাকে আমাদের কাছে খুব সহজেই পৌঁছে দেয় এবং আমরা আবিষ্কার করি যে, আপাত তুচ্ছ অনেক বিষয়, যা নিয়ে আমরা কখনোই চিন্তা-ভাবনা করিনা, সেগুলো যে কত প্রয়োজনীয়, রবীন্দ্রনাথ তাঁর অভিব্যক্তিতে তা আমাদের সামনে সাবলীলভাবে হাজির করেছেন –

এক: ‘‘প্রাচীরের ছিদ্রে এক নামগোত্রহীন/ফুটিয়াছে ছোটো ফুল অতিশয় দীন।/ ধিক্্ ধিক্্ করে তারে কাননে সবাই;/ সূর্য উঠি বলে তারে, ভালো আছ ভাই?”

দুই: ‘‘কে লইবে মোর কার্য, কহে সন্ধ্যারবি-/ শুনিয়া জগৎ রহে নিরুত্তর ছবি।/ মাটির প্রদীপ ছিল; সে কহিল, স্বামী,/ আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি।

তিন: ‘‘রথযাত্রা, লোকারণ্য, মহা ধুমধাম-/ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম।/ পথ ভাবে ‘আমি দেব’, রথ ভাবে ‘আমি’,/ মূর্তি ভাবে ‘আমি দেব’- হাসে অন্তর্যামী।”

ওপরের ক্ষুদ্রায়তন পদ্যগুলো রবীন্দ্রনাথের লেখা কনিকা’র অন্তর্গত। লক্ষ্য করা সম্ভব হবে যে, এগুলো আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে, চিন্তা-ভাবনায় কিংবা জীবন দর্শনে অতি প্রাসঙ্গিক।

আমি এবারে দৃষ্টি ফেরাব এমন একটি বিষয়ের দিকে, যার সঙ্গে আমার যোগ চার দশকের। আমি অতি সীমিত কিছু উদাহরণের মাধ্যমে নাটকে রবীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গিকতা এবং তাঁর শাশ্বত অবস্থানটি তুলে ধরবার চেষ্টা করব। রবীন্দ্রনাথের অতি পরিচিত একটি নাটক রক্তকরবী, যে নাটকের নায়িকা নন্দিনী এবং তাঁর প্রতিপক্ষ হল রাজা। এদের দুজনের মাঝে প্রায়ই তর্ক বাধে। রবীন্দ্রনাথ নন্দিনী এবং রাজার বর্ণনা দিয়েছেন নিভৃতচারী প্রাচ্য এবং স্বৈরাচারী প্রতিচ্য হিসেবে। এখানে একটি সংলাপ উল্লেখ করি-

নন্দিনী : ‘‘হঠাৎ তোমার এ কী ভাব! লোকে তোমাকে ভয় করে এইটেই দেখতে ভালবাসো? আমাদের গাঁয়ের শ্রীকন্ঠ যাত্রায় রাক্ষস সাজে – সে যখন আসরে নামে তখন ছেলেরা আঁতকে উঠলে সে ভারি খুশি হয়। তোমারও যে সেই দশা। আমার কী মনে হয় সত্যি বলব? রাগ করবে না?”
রাজা : কী বলো দেখি।
নন্দিনী : ভয় দেখাবার ব্যাবসা এখানকার মানুষের। তোমাকে তাই তারা জাল দিয়ে ঘিরে অদ্ভুত সাজিয়ে রেখেছে। এই জুজুর পুতুল সেজে থাকতে লজ্জা করে না!

মুক্তধারা-নাটকে সাধারণ মানুষের সাথে স্বৈরচারের সংগ্রামের কথাই লিপিবদ্ধ হয়েছে। স্বৈরাচারী যে, সে তার সকল শক্তি নিয়ে সাধারণ মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। কিন্তু সেখানেও সেই জনগণের মাঝে রয়েছে এক মুক্তিদাতা, যে পথের নির্দেশ দেয় সকলকে। রাজা রণজিৎ এবং বৈরাগী ধনঞ্জয়-এর মাঝে কথোপকথন হচ্ছে –

রণজিৎ : পাগলামি করে কথা চাপা দিতে পারবে না। খাজনা দেবে কি না বলো।
ধনঞ্জয় : না, মহারাজ, দেব না।
রণজিৎ : দেবে না? এত বড়ো আস্পর্ধা?
ধনঞ্জয় : যা তোমার নয় তা তোমাকে দিতে পারব না।
রণজিৎ : আমার নয়?
ধনঞ্জয় : আমার উদ্বৃত্ত অন্ন তোমার, ক্ষুধার অন্ন তোমার নয়।
রণজিৎ : তুমিই প্রজাদের বারণ কর খাজনা দিতে?
ধনঞ্জয় : ওরা তো ভয়ে দিয়ে ফেলতে চায়, আমি বারণ করে বলি প্রাণ দিবি তাঁকেই প্রাণ দিয়েছেন যিনি।
রণজিৎ : তোমার ভরসা চাপা দিয়ে ওদের ভয়টাকে ঢেকে রাখছ বৈ তো নয়। বাইরের ভরসা একটু ফুটো হলেই ভিতরের ভয় সাতগুণ জোরে বেরিয়ে পড়বে। তখন ওরা মরবে যে। দেখো, বৈরাগী, তোমার কপালে দুঃখ আছে।
ধনঞ্জয় : যে দুঃখ কপালে ছিল সে দুঃখ বুকে তুলে নিয়েছি। দুঃখের উপরওআলা সেইখানে বাস করেন।

সামাজিক কর্তব্য, মানবতাবোধ এবং মানবিকতার বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের অন্তর্দৃষ্টি যুগোত্তীর্ণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। আমি ওপরে কেবল কয়েকটি উদাহরণ তুলে দিলাম। আমি নিশ্চিত যে, কোন গবেষক সহজেই রবীন্দ্রনাথের চিরায়ত অবস্থান সম্পর্কে আরও অনেক উদাহরণ দিয়ে আমাদেরকে ঋদ্ধ করতে পারবেন। আমরা যতই তাঁকে পড়ছি, তাঁকে জানছি, ততই বুঝতে পারছি যে, রবীন্দ্রনাথের মানবিকতা, গভীরতা এবং প্রাসঙ্গিকতা সর্বব্যাপী।

আলো দিয়ে আলো জ্বালা
মাঝে মাঝে ভাবি কি দূর্ভাগা আমরা যে, সকল বিষয়ে হাজার কথা লেখা থাকলেও কোন গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় আমাদের অনুমানের কথা বলি অথবা অন্যের অনুমানের ওপর নির্ভর করে আমাদের অভিমত দেই। নিজেদেরকে দূর্ভাগা বললাম এই কারণে যে, একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক আমরা পড়াশোনার ব্যাপারে আজ এতটাই অনাগ্রহী। আমরা নিত্যই অকাজের কাজের পেছনে দৌঁড়ুতে, দৌঁড়ুতে এতই ক্লান্ত যে পড়াশোনা বিষয়টিকে সম্পূর্ণভাবে আমাদের জীবন থেকে বর্জন করেছি।

আমাদের বাল্যকালে গুরুজনেরা সবসময় আমাদের বইয়ের প্রতি আগ্রহী হতে বলতেন। কিন্তু অগ্রসরমান সময়ে সব বিষয়েই চরম অধৈর্য্য হয়ে পড়েছি আমরা। আমাদের পড়ার সময় কোথায়? কোন একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা উঠলেই অনেকে, বিশেষ করে তরুণ স¤প্রদায়ের অনেকে বলেন, “আমরা তো ছিলাম না। অতএব আমরা কী করে জানবো?” এমনকি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ সম্বন্ধেও এই ধরনের অজুহাত শুনতে শুনতে গা সওয়া হয়ে গিয়েছে এখন। তবুও আমি সবাইকে বলি, যা আমাদের জ্ঞানের বাইরে তা রয়েছে হাতের কাছেই, বইয়ের মধ্যে। একবার চোখ বুলালেই অনেক না জানা কথা জানা যায়। অনেক না শোনা কথা শোনা যায়। পাঠের ব্যাপারে আমাদের এই দৈন্যতার জন্য “শিক্ষিত অশিক্ষিতের” সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। একটা চাকরী নেওয়ার জন্য ডিগ্রী পেতেই হবে। তাই কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া, ডিগ্রী অর্জন, কিন্তু সত্যিকার অর্থে শিক্ষা লাভ? নৈবচ, নৈবচ।

আজকাল এড়ড়মষব ইড়ড়শং বলে একটি সাইটে গেলে বইও পড়তে পাওয়া যায়। এইভাবে বই পড়ার ব্যাপারটা আমার ভালো লাগেনা। আসলে কম্পিউটার নির্ঝঞ্জাটে এবং সহজে অনেক তথ্য, উপাত্ত আমাদের কাছে চোখের পলকে হাজির করতে পারে এটা সত্য। তবে একটা মনের মত বই হাতে নিয়ে, টেবিলের ওপরে রেখে অথবা আয়েশ করে চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে শুয়ে, বসে পড়ার আনন্দই আলাদা। অথচ আমাদের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস ক্রমেই বিলুপ্ত হচ্ছে। আমরা বই পড়ার বিষয়ে এখন খোঁড়া যুক্তি দেখাই যে হাতে সময় নেই। এটি নিতান্তই হাস্যকর। সময় নষ্ট করার সময় সকলেরই আছে প্রচুর কিন্তু বই পড়ার সময় নেই।
প্রসঙ্গত প্রখ্যাত লেখক সৈয়দ মুজতবা আলীর একটি মজার গল্প মনে পড়ে গেল। এক অবস্থাপন্ন মহিলা একটি বড় ডিপার্টমেন্ট স্টোরে গেছেন তার স্বামীর জন্মদিনের উপহার কিনতে। দোকানের সেলস্ম্যান যা-ই দেখাচ্ছেন তা ঐ মহিলার পছন্দ হচ্ছে না। পরিধেয় বস্ত্রাদী দেখালে বলছেন, “এগুলো ওর অনেক আছে।” টাই দেখালেও বলছেন,“এগুলোও ওর অনেক আছে।” পারফিউম বা কলম দেখালেও একই কথা বলছেন। অবশেষে দোকানী বললেন, “কিছু ভালো বই স¤প্রতি এসেছে, তারই একটা নিয়ে যান।” মহিলা বললেন, “বইও তো বাড়িতে ’একটা’ আছে।”

এক আলোচনায় বিতর্ক উঠেছিল বই এবং সিনেমা দেখার ওপরে। সেই বিতর্কে আমিও শামিল ছিলাম। আমি বলেছিলাম যে আমি বই পড়ার পক্ষে, কেননা একটি বই যখন পড়ছি তখন আমি আমার নিজের কল্পণায় বইয়ের ঘটনাগুলো এবং দৃশ্যগুলো নিজের মত করে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। অর্থাৎ আমি আমার নিজস্ব ছবি তৈরী করছি। আর যখন আমি একটি সিনেমা দেখি সেটা হয় অন্যের চোখে দেখা । যিনি নির্মাতা তিনি দেখেন আর আমি কেবল তার স্বাক্ষী হয়ে থাকি। একজন ভালো নির্মাতার সৃষ্টির দ্বারা আমি বিমোহিত হতে পারি কিন্তু সেই সৃজনতো আমার নিজের নয়? পাঠক আপনারা কেউ কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারেন যে “বাঁশবাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ঐ , মাগো আমার শোলক বলা কাজলা দিদি কই ?”- এটি আপনি যেখাবে চিন্তা করবেন, ঠিক একইভাবে আর কেউ চিন্তা করতে পারবে? এই যে চিন্তার নিজস্বতা তা বইয়ের পাতায় পাতায় ধরা থাকে। বই পড়তে পড়তে আমরা বেদনায় কাঁদি, সুখে হাসি। এটা আর কোন ভাবেই সম্ভব নয়।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে এই যে, বই বই বলছি তা পাই কোথায়? এই প্রশ্নটি ওঠা স্বাভাবিক এবং বস্তুনিষ্ঠ আর এখানেই গ্রন্থাগার বা লাইব্রেরির যৌক্তিকতা সম্বন্ধে আমরা সচেতন হতে পারি। আমার মনে আছে আমরা যখন কৈশোর থেকে যৌবনে উত্তীর্ণ হলাম তখন আমাদের বই সংগ্রহ করার জন্য এই ঢাকার-ই গেন্ডারিয়া পাড়ায় সীমান্ত গ্রন্থাগার নামে একটি লাইব্রেরি ছিলো। এখানে সদস্য হলে দু’ সপ্তাহের জন্য এক বা একাধিক বই সংগ্রহ করে পড়া যেত অথবা ইচ্ছে হলে ঐ লাইব্র্রেরিতে বসেই বই অথবা পত্র-পত্রিকা পড়া যেত। ঐ সীমান্ত গ্রন্থাগারে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমি কিছুদিন অবৈতনিক লাইব্রেরিয়ান হিসেবে কাজও করেছিলাম। একটি ঘর ভর্তি বই, বইয়ের মধ্যে জ্ঞান। বইয়ের ভেতরে কি আছে জানবার জন্য মস্তিষ্কের সব কোষগুলো সজীব হয়ে থাকতো। স¤প্রতি গেন্ডারিয়ায় গিয়ে দেখলাম সীমান্ত গ্রন্থাগার এখনও আছে। একটু বড়ও হয়েছে বুঝিবা। কিন্তু বই পড়ার আকুল আগ্রহ এখনও আছে কি? থাকলে আমার চেয়ে বেশি আনন্দিত আর কেউ হবে বলে মনে হয়না।

একসময় বাংলাদেশের সর্বত্র মানুষ জ্ঞানের অন্বেষণে লাইব্রেরি অথবা সাধারণ পাঠাগারের স্মরণাপন্ন হতো। আমার জানা মতে এই রকম কিছু অসাধারণ পাঠাগার বোধ হয় এখনও বিদ্যমান। তার মধ্যে নড়াইলে অবস্থিত লোহাগড়ার পাঠাগার কিংবা কুমিল্লার ‘ঈশ্বর পাঠশালার পাঠাগার’ একসময় আমার মন কেড়েছিল। ঈশ্বর পাঠশালার পাঠাগারে তখন তাল গাছের পাতায় লেখা পুঁথি সযতেœ সংরক্ষিত ছিলো।
বাংলাদেশের বিভিন্ন গ্রাম, গঞ্জ, জনপদে এই ধরনের কিছু কিছু পুরনো পাঠাগার এখনও দেখতে পাওয়া যায়। তবে সেখানে পাঠকের সমাবেশ হয় কিনা সে বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ নই। স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ আস্তে আস্তে কমে গেছে। সেই জায়গায় সৃষ্টি হয়েছে এমন একটি সমাজ যেখানে কেবলই বিত্ত-বৈভবের দিকে ধাবমান সকল মানুষ।

জ্ঞানার্জনের প্রতি আগ্রহের বিষয়ে এক প্রচন্ড খরা বিদ্যমান আমাদের সমাজে। তবুও আশাহত নই আমি। অতি স¤প্রতি আমার নিজ গ্রামের পার্শ্ববর্তী একটি গ্রামে আমার অনুজপ্রতিম বন্ধু সাংবাদিক গৌরাঙ্গ দেবনাথ আমাকে একটি লাইব্রেরি দেখতে নিয়ে গেল। অতি ক্ষুদ্র একটি গ্রন্থাগার। নাম ‘গুঞ্জন পাঠাগার’। আয়তাকার একটি কক্ষে কয়েকটি আলমারি। মাঝখানে একটি পড়ার টেবিল। পাশে লাইব্রেরিয়ানের বসার জন্য একটি টেবিল। সেইখানে ঘর আলো করে বসে আছে এক তরুণ। নাম হাবিবুর রহমান স্বপন। সর্বদাই তার মুখে লেগে আছে অমলিন হাসি। স্বপন যেন মন খারাপ করতে জানে না। তারই একক প্রচেষ্ঠায় প্রাইভেট টিউশন থেকে বাঁচানো অর্থে এই পাঠাগারটি গড়ে উঠেছে। তার নিজের বাড়ির উঠোনের এক কোণে টিনের তৈরী এই লাইব্রেরি ঘর। সেখানে রয়েছে সকলের প্রবেশাধিকার। যেন উদাত্ত কন্ঠে এক আহবান ‘জ্ঞান চাই? তাহলে বইয়ে সান্নিধ্যে এসো।’ ঐ প্রসন্ন অপরাহ্নে মনটা বড় ভালো হয়ে গেল। যখন, সারা দেশে বিরাজ করছে জ্ঞান চর্চার খরা তখন একটি অজ পাড়া গাঁয়ে প্রাইভেট টিউটর এক তরুণ নিজের উপার্জনের অর্ধেকেরও বেশি বিনিয়োগ করে প্রতিষ্ঠা করেছে একটি লাইব্রেরি এবং সমপরিমাণ অর্থ প্রতিমাসে ব্যয় করে সেই লাইব্রেরিটিকে ধরে রেখেছে জ্ঞান পিপাসু মানুষের জন্য। হঠাৎ মনে হলো হয়তো আমাদের হতাশ হবার কিছু নেই। বাংলার প্রতিটি গ্রামে অন্তত একজন এই রকম তরুণ রয়েছে যার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় জ্ঞান আহরণের জন্য এই ধরনের আরও হাজার, হাজার পাঠাগার নির্মান সম্ভব। প্রয়োজন কেবল আমাদের হৃদয়ে একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করার। তাহলেই হবে আলো দিয়ে আলো জ্বালা।

আবার এসেছে আষাঢ়

সাম্প্রতিক কালে ঢাকাবাসী আমরা প্রায় বুঝতেই পারি না কখন আষাঢ় এল, কখন শ্রাবণ গেল। বর্ষার সেই অবিরাম জলধারা, আকাশের জলস্পর্শে আধপোড়া মাটি থেকে সোঁদা গন্ধ, চারপাশের বৃক্ষরাজি এবং সকল প্রকার তরুলতার উজ্জীবিত হয়ে ওঠা, আকাশ ভরা কালো মেঘের ঘনঘটা, মানুষের মনে একধরনের উৎফুল্ল ভাব, সকলই কোথায় যেন হারিয়ে গেছে কোন সুদূরে। এমন এক সময় এসেছে এখন, যখন আলো অন্ধকারে, অথবা যেখানেই যাই না কেন, মাথার ভেতরে কেবলই নিরানন্দ জাগতিক চিন্তা আমাদের উতলা করে। আমরা ভুলেই যাই আমাদের চারপাশে সকল উদ্দেশ্য এবং বিধেয় ছাপিয়ে, সকল কাজকে দূরে ঠেলে দিয়ে অকাজেরও এক সৌন্দর্যপ্রভা ঋতুতে, ঋতুতে রঙ বদলায়। আষাঢ়ে, সাধরণত কখনওই ঘন বর্ষা হয় না। হালকা অথবা মাঝারি ধরনের বৃষ্টি দিনরাত চলতে থাকে। বাল্যকাল থেকে আমরা তা-ই দেখে এসেছি। আজ যে প্রকৃতি সকল ব্যাপারেই প্রায় অনিশ্চয়তায় ছেয়ে গেছে, তার পেছনে নাকি বৈশ্বিক উষ্ণায়ন দায়ী। হতে পারে। তবে এ নিয়ে ভাববেন আবহাওয়াবিদরা। আমার দুঃখ, এই উষ্ণায়নের ফলে যা কিছু সুন্দর ছিল আমাদের বাল্যকালে কিংবা যৌবনে, নিসর্গ নির্ভর, সব আজ হারিয়ে বসেছি আমরা।

এই বর্ষায় অনেকদিন আগের কথা মনে পড়ছে। বর্ষার শুরুতেই হালকা বৃষ্টি শুরু হত এবং ক্রমে তা গাঢ়, ঘন হয়ে উঠত। আমরা প্রথম বৃষ্টির রাতে খিচুড়ি খেয়ে ঘুমাতে যেতাম। মাঝরাতে হঠাৎ বৃষ্টির শব্দের সাথে মত্ত হাওয়া মিলেমিশে এমন এক আবহের সৃষ্টি হত যে, আমরা তড়াক করে ঘুম থেকে উঠে বসতাম। ভারি ভাল লগত। আবার ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছে করত না। কিন্তু সেই বৃষ্টি ও হাওয়ার শব্দেই কখন যে ঢুলুনি আসত, কখন যে ঢলে পড়তাম ঘুমের ঘোরে, তা বুঝতেও পারতাম না। পরের দিন সকালে উঠলেই দেখতাম চারপাশ ভেসে যাচ্ছে। মনটা উৎফুল্ল হয়ে উঠত। এই রকম পরিস্থিতি মানেই জধরহু উধু উপলক্ষে স্কুল ছুটি। ক্লাস করার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি। নাশ্্তা খাওয়ার পরে ৯টা বাজতে না বাজতেই ফুটবল হাতে হাজির হতাম বাড়ির কাছের মাঠে। সেখানে তখন জল জমে গেছে। শুরু হত আমাদের খেলা, চলতো পরম আনন্দে। একসময় আমার ছোড়দা, আমার জ্যাঠাতো ভাই আসতেন। পানির ধারে এসে তিনি পানির স্পর্শ বাঁচিয়ে দাঁড়াতেন এবং আমাকে উদ্দেশ্য করে বলতেন, ‘‘এই যে, অনেক হয়েছে, এবারে বাড়ি চল। আম্মার পাখার ডান্ডা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।” তেমন ভয় পেতাম না। কেননা আমার মায়ের হাতে তালপাখার ডান্ডাটি উদ্যত থাকলেও আমার পৃষ্ঠপ্রদেশ তা কখনওই স্পর্শ করত না। তবুও খেলায় ক্ষ্যান্ত দিয়ে বাড়ির পথে রওনা হতাম। বেচারা ফুটবল একাকী পড়ে থাকত জলের ওপরে। বাড়ি পৌঁছুতেই টের পেতাম চারিদিক ম ম করে উঠেছে সদ্য রান্না করা খিচুড়ির গন্ধে। সেই সঙ্গে ভাজা ইলিশের সুবাস ভেসে আসত। এতক্ষণ যে খিদে ভোলানো খেলায় ভুলে ছিলাম খিদের কথা, সেই খিদে চনমনিয়ে উঠত পেটে।

ঐদিনগুলোতে বুড়িগঙ্গা নদীর খুব কাছেই থাকতাম আমরা। তখন বুড়িগঙ্গার হাল আজকের এই নোংরা, এঁদো নর্দমার মত হয়নি। আমরা বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে কোষা নৌকা ভাড়া নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম নদী বক্ষে। অনেক রাতের অন্ধকারে যখন বৃষ্টির শব্দ আর বাইরের অন্ধকার এক ভৌতিক আবহের সৃষ্টি করত, তখন আমরা আমাদের দিদিকে ঘিরে বসতাম ভূতের গল্প শোনার জন্য। কী সব রোমাঞ্চকর দিন ছিল সেইসব! বাংলার বৃষ্টির এমন মাধুর্য, বাংলার বর্ষা এমন এক ঋতু, যা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে প্রায় সকল কবি সাহিত্যিকই আবেগপূর্ণ লেখা লিখেছেন। তবে এ সম্বন্ধে একবার আমার এক বৃটিশ বন্ধু আমায় বলেছিলেন, ‘‘তোমরা এক অদ্ভুত জাতি বটে। তোমরা জান যে বর্ষাকালে অবধারিতভাবে বৃষ্টি আসবেই। তবুও তোমরা অপ্রস্তুত থাক। যখনই বৃষ্টি আসে, যেন অবাক হয়ে যাও তোমরা। ছুটাছুটি শুরু করে দাও ছাতা, রেইন কোট কিংবা অন্য কোন আচ্ছাদনের জন্য। আগে থেকে প্রস্তুত থাকলে এমন শেষ মুহুর্তের অনিশ্চয়তা থেকে বাঁচা যায়।” আমি তাকে কিছুতেই বোঝাতে পারিনি যে, এই অপ্রস্তুত কিংবা অবাক হয়ে যাওয়ায় যে অপার আনন্দ, সেটা তাঁর পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। আমরা, বাঙালিরা, এই রোমান্টিসিজম নিয়েই দিব্যি বেঁচে আছি হাজার বছর ধরে।

এই আষাঢ়ে চলুন না বেরিয়ে পড়ি বৃষ্টির ঘ্রাণ নিতে, বৃষ্টির আশীর্বাদ মেখে নিতে সারা শরীরে। চলে যাই শহর থেকে গ্রামে, কিংবা আরও দূরে! চলে যাই বাংলাদেশের সেই প্রত্যন্ত অঞ্চলে, সেখানে কাদামাখা জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকি। হয়তো কিছু ভাবি, হয়তো কিছুই ভাবিনা!!