আমার অংগীকাররে গল্প

 

বিরাট এক যুদ্ধ শেষে ফিরেছি দেশে। স্বাধীন দেশের নবযাত্রার সুচনায় তখনও থিতু হয়ে বসবার কথা আমলে নেইনি। কিন্তু কি করবো তা নিয়ে ভাবনা শুরু করতেই হলো। একদিন সকালে আমার দুই প্রাক্তন সহকর্মী, আমার তৎকালীন বাসস্থান, আমার ভাইয়ের নারিন্দার বাসায় এসে বললো যে যুদ্ধের নয়মাস তাঁরা বেতারে আমার কণ্ঠ শুনতো আর ভাবতো আমি কবে দেশে ফিরবো ? ওরা আমার ফেরার প্রত্যাশাতেই ছিলো। আমি ফিরে এলেই আবার কাজ শুরু হবে এশিয়াটিকে। কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। সূতরাং সেই মূহুর্তেই সিদ্ধান্ত নিলাম যে ফিরে যাবো নিজেরই ঘরে আবার। সেই থেকে এখন অবধি সেই এশিয়াটিকেই আছি। ১৯৭২ এর ৮ ফেব্রুয়ারী, সরকারের অনুমোদন নিয়ে প্রশাসক হিসেবে ইস্ট এশিয়াটিকের কাজ আরম্ভ করলাম। আমরা তখন ছিলাম আটজন। এর মধ্যে ছয়জনই আমার সাবেক সহকর্মী। বাকী দু’জন, ‘অফিস সহকারী’র নিয়োগ দেয়া হলো নতুন করে।

ওই দিন অর্থাৎ বাহাত্তরের ৮ই ফেব্রুয়ারী , আমি ইস্ট এশিয়াটিকের অফিসের তালা ভেঙে আমার পুরনো কর্মস্থলে পুণঃপ্রবেশ করি। ভেতরে সবকিছু দেখেশুনে মনটা বড় খারাপ হয়ে যায়। ধুলোর আস্তরণে ঢাকা আসবাব পত্রগুলো, যেন কত কিছু বলবার অপেক্ষায় ছিল। মনে হচ্ছিল কোন একদিন কর্মযজ্ঞ শেষে হঠাৎ করেই সব মানুষগুলো কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। চেয়ার, টেবিল, ফাইল, কাগজ এবং কলম যেখানে যেটি ছিল সেইভাবেই পড়ে আছে, ধুলোয় আকীর্ণ অবস্থায়। আমি গোটা অফিস সাফ-সুতরো করে ইস্ট এশিয়াটিককে আবার চালু করার দিকে মনোযোগ দিলাম। কিন্তু তখন হাতে কোন ব্যবসা ছিল না এবং আমরা সবাই জানি যে প্রতিযোগীতামূলক বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা না থাকলে বিজ্ঞাপনের কোন প্রয়োজন থাকে না। যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ তখন বিক্রেতার স্বর্গরাজ্য। ক্রেতার কোন চাহিদা নেই। অতএব, বিজ্ঞাপনের প্রয়োজনীয়তাও নেই। আমি বিজ্ঞাপনের প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টির কাজে নিজেকে নিয়োজিত করলাম। বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের দ্বারে দ্বারে ঘুরে তাদেরকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম যে একটি সদ্য স্বাধীন দেশের মানুষকে দেশপ্রেমে অটুট রাখার জন্যে জাতীয় দিবসগুলোতে দেশাত্মবোধক বিজ্ঞাপন পত্র-পত্রিকায় দেয়া দরকার যেন সাধারণ মানুষ হতদ্যোম না হয়ে আশায় বুক বেঁধে দাঁড়াতে পারে। ১৯৭২ এর ২১শে ফেব্রুয়ারী এক অসাধারণ বিজ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে ইস্ট এশিয়াটিকের পুণর্জন্ম হলো। পত্রিকায় এ বিজ্ঞাপনটির ইলাস্ট্রেশনে দেখা যাচ্ছিল কলাপাতার উপরে একটি বাচ্চার হাতে খাগের কলমে লেখা ’অ’ অক্ষরটি। ক্যাপশন ছিল, ”আহা, আমার দুঃখীনি বর্ণমালা।” এই অসাধারণ বিজ্ঞাপনের কপিটি লিখেছিলেন বাংলাদেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমান। এই কথাগুলো এখনও মনে পড়লে গায়ে কাঁটা দেয়। কী এক অসাধারণ সময় গিয়েছে তখন!

’৬০ এর দশকের শেষ ভাগে একটা প্রবনতা ছিল যে বিজ্ঞাপন ব্যবসায় প্রতীচ্যকে চোখ বন্ধ করে নকল করা। অর্থাৎ একটি মার্কিন বিজ্ঞাপন ভাল লাগল তো সেটিকে বঙ্গজীকরণ করে চালিয়ে দিলাম। আমি আবিষ্কার করলাম যে এইভাবে অন্ধ অনুকরণ করে আমরা বিজ্ঞাপনের মূল কাজটি থেকে অনেক দূরে সরে আসছি। বিজ্ঞাপনকে ইংরেজীতে আজকাল Communication Business বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা অভীষ্ট জনগোষ্ঠীর সাথে একটি যোগাযোগ স্থাপন করি। অন্ধ অনুকরণ এই যোগাযোগকে ব্যাহত করে। আমি আবিষ্কার করি যে যেইসব জনগোষ্ঠীর সাথে একটি পণ্য কি সেবার স্বার্থে আমার যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে তাদেরকে সম্পূর্ণভাবে জানা আমার কর্তব্য। অতএব এ বিষয়ে কিছু পদক্ষেপ নেয়া দরকার। সেই থেকেই মার্কেট রিসার্চ কিংবা বাজারজাতকরন সমীক্ষা সম্বন্ধে আমি জ্ঞানার্জন করার চেষ্টা শুরু করি। আমি আমার পেশার প্রতি আরও গভীর পেশাগত চিন্তা-ভাবনায় উদ্যোগী হই। দেশ স্বাধীন হবার পরে আমি যখন বিজ্ঞাপন পেশায় ফিরে এলাম তখন প্রথমেই আমি ভাবলাম যে যাদের উদ্দেশ্যে বিজ্ঞাপন করব তাদেরকে আমার জানা দরকার। তখন আমার একজন অগ্রজ প্রতীম বন্ধু ছিলেন শ্রী চিত্ত মিত্র, যিনি কলকাতায় মার্কেট রিসার্চ এর কাজ করতেন। তাকে অনুরোধ করলাম এই ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করতে। তিনি সাগ্রহে তাতে সম্মতি দিলেন। অতএব সেই ’৭২ এই আমরা বাংলাদেশে নানা শ্রেনীর ভোক্তাদেরকে জানার জন্যে একটি বিশেষ সমীক্ষা চালায়। ইংরেজীতে এর নামকরণ করেছিলাম Market Mapping Study এই কথাগুলো বললাম এই কারনে যে, আমার পেশার সেই শুরু থেকে আজ পর্যন্ত আমি পেশাদারী মনোভাব নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করেছি।

সদ্য স্বাধীন বিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থনীতি তখন এতই নাজুক ছিল যে এখানে প্রতিযোগীতামূলক বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়া যে আদৌ শুরু হবে সে সম্বন্ধে কোন নিশ্চয়তা ছিলনা। অথচ আমরা সবাই জানি যে ব্যবসা এবং শিল্পায়ন উন্নত মানের না হলে বিজ্ঞাপনের কোন প্রয়োজন পড়ে না। অতএব, আমাদেরকে অনেক কষ্টে দিনাতিপাত করতে হয়েছে তখন। অধিকাংশ মাসে আমরা যারা উচ্চাসনে সমাসীন ছিলাম, কখনই পুরো বেতন নিতে পারিনি। প্রচন্ড পরিশ্রম করতে হয়েছিল। এই সময় আমার কাজ ছিল, বাজারজাতকরণ সম্বন্ধে নব্য ব্যবসায়ীদেরকে শিক্ষিত করা। অনেক সময় গেছে এই কাজটির পেছনে। আস্তে আস্তে বাংলাদেশের অর্থনীতি মোটামুটি একটি চলমান অবস্থায় এসে দাঁড়ায়। খুবই মৃদু মন্দ গতিতে আমাদের ইস্ট এশিয়াটিকের ব্যবসা সামনের দিকে এগুতে থাকে। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ রূপান্তরিত হয়েছিল বিক্রেতার বাজারে। এখানে ক্রেতা সিদ্ধান্তের কোন স্থান ছিল না। এই রকম একটি পরিস্থিতিতে আমার ইস্ট এশিয়াটিক নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়াটা হয়ত ভুল হয়েছিল। সেই অস্থিরতার সময়ে আরও অনেক সহজ উপায় ছিল হয়তো একটি স্বচ্ছল জীবন গড়ে তোলার। কিন্তু আজ স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশত বছর পরে এসে আমি উপলব্ধি করি যে কোন বিষয় নিয়ে লড়ে যাওয়ার পেছনে যে আত্মশ্লাঘা আছে তার তুলনা হয়না। বিশেষ করে ওই পরিশ্রমের ফলে সাফল্য যদি আসে। কেবল ৮ জন সহকর্মী নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলাম সেই ৮ই ফেব্রুয়ারী, ১৯৭২ এ আমার এই ছোট্ট প্রতিষ্ঠান ইস্ট এশিয়াটিকের ওপরে ভর করে। আজ এশিয়াটিকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৬টি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। যাকে আমরা ’এশিয়াটিক থ্রি সিক্সটি’ বলে জানি। আমাদের নিয়মিত কর্মীর সংখ্যা সাড়ে ৬০০ এর বেশি। আমি কোনভাবেই আমার সাফল্যকে মহৎ হিসেবে বিবেচনা করি না। তবে এই সাফল্যের পেছনে যে একটি জেদ কাজ করেছিল, যুদ্ধ করার একটা মনোবৃত্তি, তা নিয়ে যথেষ্ট আত্মতৃপ্তি আমার আছে। আজ হয়তো নিঃশঙ্কোচে বলাই যায়, ”আমার একটা জেদ ছিলো।” আমার সেই জেদ, চ্যালেঞ্জের মুখোমুিখ হয়ে মুখ ঘুরিয়ে না নেয়ার যে প্রবণতা সেটা এ পর্যন্ত কখনও আমাকে হতাশ করেনি। শুরুতে কষ্ট হলেও শেষমেশ আমি সাফল্য দেখেছি। এই প্রত্যয় নিয়ে জীবনের সাতটি দশক পার করে এলাম। ইংরেজীতে একটি কথা আছে, ”এবং পেছন ফিরে তাকাইনি কখনও”। এই বাক্যটির সত্যতা আমার জীবনে আমি প্রত্যক্ষ করেছি। মুক্তিযুদ্ধের পর দেশে ফিরে এসে যখন এশিয়াটিকের কাজ শুরু করলাম আবার, তখন আমার একটা পরিকল্পনা ছিল। আমি চেয়েছিলাম যে বাংলাদেশে, বাজারজাতকরণের একটি মূল উপাদান – ’ভোক্তার সঙ্গে যোগযোগ’ এই বিষয়ে একটি যথার্থ প্রতিষ্ঠান তৈরী করা। আজ নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে আমার সেই ইচ্ছে পরিপূর্ণ রূপ ধারণ করেছে এশিয়াটিকের সাফল্যের মাধ্যমে।

উৎস: মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ !