ভালবাসাময় নষ্টালজিয়া

সারা জীবন সবাই মিলে একসাথে হৈ হুল্লোড় করে দিন কেটেছে আমার। এর বেশিরভাগই কেটেছে পরিবারের সবার সাথে। বস্তুতপক্ষে এই পরিণত বয়সে এসে পেছন ফিরে তাকালে বুঝতে পারি আমার সকল আনন্দ-উদ্দীপনা, সকল আবেগ-আতিশয্য পরিবারকে কেন্দ্র করেই। সেই উনিশশো’ উনসত্তরে আমার নানা-নানীর বিবাহ বার্ষিকী পালন করেছিলাম কালকাতায়। সেই সময় গুনে দেখেছিলাম যে, আমার নানার বংশ উদ্ভূত আপন মামাতো খালাতো ভাইবোনের সংখ্যাই ছিলো তেতাল্লিশ। আমরা সবাই ছিলাম, কথ্য ভাষায় যেমন বলা হয়ে থাকে, মায়ের দিকের ফার্স্ট কাজিনস্। আমি যখন যুদ্ধ থেকে ফিরলাম, ভাইয়া, অর্থাৎ বড় ভাই-ভাবী তাঁদের প্রথম কন্যা সন্তানকে নিয়ে তখন নারিন্দার একটি দুই কামরার বাসায় থাকেন। আমি ভাইয়ার সাথেই থাকতে শুরু করলাম। আমি এই সময় আমাদের থাকার উপযোগী একটা বাড়ির খোঁজ শুরু করলাম এবং কী আশ্চর্য পেয়েও গেলাম! আমাদের নতুন ঠিকানা হলো রাজারবাগে। ‘ছায়ানীড়’ নামে একটি ছিমছাম দ্বিতল বাড়ির দোতলায় আমাদের আবাস হলো।

দেশে ফেরার পর কি করব সেই সিদ্ধান্ত তখনও নেইনি। তবে আমার স্বাধীন বাঙলা বেতার কেন্দ্রের অভিজ্ঞতার কারনে বাংলাদেশ বেতারে ইংরেজী কথিকা এবং সংবাদ পাঠ করতাম। কিন্তু একদিন সকালে আমার দুই সহকর্মী, আমার তৎকালীন বাসস্থান আমার ভাইয়ের নারিন্দার বাসায় এসে বললো যে যুদ্ধের নয়মাস তাঁরা বেতারে আমার কণ্ঠ শুনতো আর ভাবতো আমি কবে দেশে ফিরবো ? আমি ফিরে এলেই আবার কাজ শুরু হবে এশিয়াটিকে, এটাই ছিল ওদের প্রত্যাশা। এই কথার কোন জবাব আমার জানা ছিলো না। সূতরাং সেই মূহুর্তেই সিদ্ধান্ত নিলাম যে ফিরে যাবো এশিয়াটিকেই। বাহাত্তরের ৮ই ফেব্রুয়ারী, সরকারের অনুমোদন নিয়ে প্রধান প্রশাসক হিসেবে ইস্ট এশিয়াটিকের কাজ পুনরায় আরম্ভ করলাম। এশিয়াটিকে আমার কাজ চলছিল ভালই।

Aly Zaker on far right with his younger sister Farida Tarek, with his mother Razia Taher in the middle, elder sister Zohra Islam and his eldest brother Aly Taher on extreme left

আমার তারুণ্য আর দশটি তরুণের মতো ছিলনা কখনো। জীবনের শুরু থেকেই প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে আমি বাধ্য হয়েছি বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করতে। আমার ছাত্র অবস্থাতেই আমার বাবা-মা এবং দিদি মারা যান। অতএব, পরিবারের অনেক জাগতিক দায়িত্ব আমার কাঁধে এসে ভর করেছে। এরপর আমার কর্মক্ষেত্রে খুব অল্প বয়সেই নেতৃত্ব দেয়ার দায়িত্ব আমাকে অর্পন করা হয়। অতএব, আর দশটি তরুণের মতো বাঁধনহারা যৌবনের গান আমি গাইতে পারিনি কোন কালেই। কৈশোর, যৌবনের বয়ঃসন্ধি কাল থেকে শুরু করে জীবনের তিনটি দশক পেরিয়েও প্রেম করা হয়ে ওঠেনি আমার। বয়সটি কুড়ির দশক পেরিয়ে যখন ৩০ এর দ্বারপ্রান্তে উপনীত হলো তখন মনে হলো রোমান্টিকতার বাইরে বেরিয়ে এখন বোধহয় সময় এসেছে জীবনের পরবর্তী ধাপ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করবার।

বলে রাখি এক হিসেবে আমি সত্যিকার অর্থেই একটু সনাতন পন্থী। এখনও আমি নিজ বাসভূমে প্রচন্ড বিশ্বাসী । বিশ্বের যেখানেই যাই না কেন, যত মনোরম সেই জায়গা হোক, মন ফিরে আসতে চায় আপন ঘরের কোনে। আমার এক বিদেশী বন্ধুর একটি প্রশ্নের জবাবে আমি একবার বলেছিলাম, ”Home is where I belong”. ঘরই আমার প্রধান আকর্ষন। ঘরেই আমি সবচেয়ে স্বস্তি খুঁজে পাই। কিন্তু ঘরে তো মানুষও থাকতে হয়। সেই বাল্যকাল থেকে ঘরের আকর্ষনের সাথে জড়িয়ে ছিলেন বাবা-মা এবং দিদি। তাঁরা একে একে চলে গেলেন। তারপর ছিলেন আমার বড় ভাই এবং ছোট বোন। এরাও একটা সময় নিজ জীবনের ব্যস্ততায় জড়িয়ে পড়লে প্রাণস্পন্দনহীন কক্ষটিই আমার যেন জীবন্ত হয়ে উঠল। যেন দুহাত তুলে আলিঙ্গন করত আমায় যখনই ফিরে আসতাম ঘরে। কোন দিন বন্ধু বান্ধবের সাথে আড্ডায় নিমগ্ন থাকার পর অধিক রাতে বাড়ী ফিরলে ঘরটি যেন নীরব অভিমানে আমার কানে কানে বলত, ”এত দেরীতে ফিরলি?” হঠাৎ মনে হলো এই ঘরকে আরও একজন সঙ্গী দেয়ার প্রয়োজন হয়েছে এখন বোধহয়। যে সঙ্গীটি হবে আমার আদর্শের পথে হাতে হাত ধরে হাঁটার সাথী। যে আমার আনন্দে উদ্বেলিত হবে, দুঃখে ভারাক্রান্ত, পরাজয়ে ম্লান, বিজয়ে উজ্জ্বল – তাকে কী করে পাই?

Aly Zaker’s Didi, who was like a mother to him on her wedding day

এইসব চিন্তার দোলাচলে যখন আমি হাবুডুবু খাচ্ছি তখন হঠাৎ করেই আবিষ্কার করলাম চিরসঙ্গী হিসেবে, আমারই মঞ্চনাটকের সহযাত্রী সারা’কে। একদিন সাহসে বুক বেঁধে প্রস্তাবও দিলাম তাকে। সারা বলল ভেবে দেখবে। এইভাবে পেরুলো কিছুদিন। আমি হাল ছাড়িনি। একদিন কোন এক শুভক্ষনে আমার সে প্রস্তাবে রাজি হলো সে। আমি যেন হাতে স্বর্গ পেয়েছিলাম সেই দিন। অবশেষে ভবিষ্যতের একটা গতি হলো। ১৯৭৫ এর ২০শে জুন আমাদের বিয়ে হয়। আমি বিয়ে করে প্রথম যুগল সংসার পাতি ‘ছায়ানীড়’ এ।

সারা ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে ভর্তি হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগে। বিজ্ঞান বিভাগের ভালো ছাত্রী। অতএব, ছোট খাটো এক বৈজ্ঞানিক হবে এটাই ছিল আশা। আমাদের বিয়ের আগে থেকেই বের্টল্ট ব্রেশটের ’সৎ মানুষের খোঁজে’ নাটক করার পরিকল্পনা নিয়েছিলাম দল থেকে। ওই নাটকে সেন্তি এবং সুইতা “নারী এবং পুরুষ” নামের দ্বৈত চরিত্রে অভিনয়ের জন্য নির্বাচিত হয়েছিল সারা। বাংলা রূপান্তরে ওই চরিত্র দুটির নামকরন করা হয়েছিল ফুলি এবং ফুল মোহাম্মদ। বেশ শ্লথ গতিতে চলছিল মহড়া। এই কারনে যে ওই নাটকে ছিল অনেক চরিত্রের সমাহার। এত কুশীলব খুব সহজে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। নাটক অবশেষে তৈরী হলো। বাংলা নাম ’সৎ মানুষের খোঁজে’। মঞ্চে যখন নাটক নামল তখন সারা অন্তঃস্বত্তা। মনে পড়ে ওই অবস্থাতেই আমরা ’সৎ মানুষের খোঁজে’ নিয়ে গিয়েছিলাম চট্টগ্রামে। সেটা ছিল ১৯৭৬ সালের মার্চ মাস। সেখানে সেন্ট মেরী’স মিলনায়তনে আমরা ৩টি নাটকের ৫টি প্রদর্শনী করেছিলাম । প্রথম দুইদিন ’বাকী ইতিহাস’ এবং ’ভেঁপুতে বেহাগ’। আর তৃতীয় দিনে সকাল ১১টা, বিকেল ৪টা এবং সন্ধ্যা ৭টায় ’সৎ মানুষের খোঁজে’র তিনটি প্রদর্শনী। এখন ভাবতে অবাক লাগে যে শরীরের ওই অবস্থা নিয়েও কী প্রচন্ড পরিশ্রম এবং চরম সাফল্যের সাথে দোর্দন্ড প্রতাপে ওই সময় অভিনয় করে গেছে সারা। ’সৎ মানুষের খোঁজে’তে ওর অভিনয় ছিলো অপ্রতিদ্বন্দ্বী । সারা’র অন্তঃস্বত্তা অবস্থায় অত পরিশ্রম করে নাটক করার সংবাদটি পৌঁছে গিয়েছিল ওর বাবার কাছে। মনে পড়ে চট্টগ্রাম থেকে ফিরে এসে তার সাথে যখন দেখা করতে গেলাম তখন তিনি আমাদেরকে মহা বকুনি দিয়েছিলেন।

আমাদের প্রথম সন্তান ইরেশের জন্ম ১৯৭৬ এর ৬ই নভেম্বর । আমার এবং আমার প্রথম সন্তানের জন্ম একই দিনে অর্থাৎ ৬ই নভেম্বর, শনিবার। বস্তুতপক্ষে আমার দ্বিতীয় সন্তান, শ্রিয়া সর্বজয়া যার জন্ম প্রায় ৮ বছর পরে, তারও জন্ম তারিখ আমাদের অর্থাৎ আমার এবং ইরেশের খুব কাছাকাছি। ১লা নভেম্বর। শ্রিয়ার জন্ম যখন হয় তখন আমি করাচীতে একটি দাপ্তরিক কাজে অবস্থান করছিলাম। ওর আমাদের মাঝে আসবার কথা ছিলো আরও একমাস পরে। অতএব নিশ্চিন্তে ছিলাম। করাচীতে মিটিং করছি এমন সময় এক সহকর্মী রুমে ঢুকে আমায় বললেন, ”Congratulations, You have been blessed with a daughter” আমি অবাক হয়ে গেলাম, সেই সঙ্গে কিছুটা শঙ্কিতও বটে। সারা’কে যখন আমি ঢাকায় রেখে আসি তখন ওর এবং ইরেশের প্রচন্ড জন্ডিস। আমার মনে শুধু শঙ্কা কাজ করছিলো! তাই বারবার জিজ্ঞেস করতে থাকলাম, ”Is my wife alright?” শ্রিয়ার জন্মের ঠিক একদিন আগে ৩১শে অক্টোবর ইন্দিরা গান্ধী নিহত হন তাঁর দেহরক্ষীদের হাতে নয়াদিল্লীতে। ইন্দিরা’র হত্যায় সারা পাকিস্তান তখন আনন্দে উন্মাতাল। তাদের সবচেয়ে বড়শত্রুর মৃত্যু হয়েছে অথচ আমি বিমর্ষ কারণ আমি মনে করি আমাদের সবচেয়ে বড় বন্ধু ছিলেন তিনি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর সমর্থন এবং সহযোগীতা না পেলে ওই যুদ্ধে আমাদের জয়লাভ করা সম্ভব হতো কিনা জানিনা। করাচীতে ইন্দিরা’র হত্যাকে কেন্দ্র করে যারা আনন্দ করছিলো তাদের বেশিরভাগই ছিলো ভারত থেকে আগত মহাজের’রা। এইসব ঘটনা মিলিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি আমার মনে একটা গভীর মমত্ববোধ সৃষ্টি হয়েছিলো। তাই তাৎক্ষণিকভাবে আমি ভেবেছিলাম যে আমার কন্যা সন্তানের নাম ইন্দিরা রাখবো। শেষ পর্যন্ত তা আর হয়ে ওঠেনি।

 

প্রসঙ্গত দাম্পত্য জীবন সম্বন্ধে আমার নিজস্ব দুই একটি কথা না বললেই নয়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, দুটো মানুষ যখন এক সঙ্গে বাস করার সিদ্ধান্ত নেয় তখন প্রত্যেককেই তার চাওয়া থেকে কিছু ছাড় দিতে হয় এবং এই ছাড় দেয়ার মাধ্যমে উভয়ের একটি বোঝাপড়ায় পৌঁছুতে হয়। নিজের পছন্দের সবকিছু সম্বন্ধে নাছোড় বান্দা হলে তখনই পারস্পারিক সংঘাতের সৃষ্টি হয়। আমাদের দাম্পত্য জীবনেও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে আমরা একে অন্যকে ছাড় দিয়েছি। কেননা আমরা প্রথম থেকেই বিশ্বাস করতাম যে যেকোন সম্পর্কে দুটি মানুষ সম্পৃক্ত থাকলে তার সব দায়-দায়িত্ব দুজনের ওপরেই বর্তায়। অতএব, একজনের ব্যাপারে আরেকের সহযোগীতা অনিবার্য হয়ে পড়ে।