আমার বাবা
এই প্রথম আমি কোন পত্রিকার জন্য লিখছি। আমি লিখব, সেই লেখা আবার কোন পত্রিকায়ে ছাপা হবে এটাই একটা বিশাল ব্যাপার মনে হচ্ছে। তাও আবার আমার বাবা কে নিয়ে লিখতে হবে। ব্যাপারটা আরও কঠিন মনে হচ্ছে কারণ আমার জন্য ভাষাগত জ্ঞান এর ভাণ্ডার ছিল আমার বাবা। কোন শব্দ বুঝতে না পারলে আমি প্রথম ফোন টা বাবা কেই করতাম। আমার মতে আমার বাবা একজন অসাধারণ লেখক ছিলেন – তা হোক ইংরেজি অথবা বাংলায়। এই লেখাটা আরও কঠিন মনে হচ্ছে কারণ বাবার চলে যাওয়ার এক মাসও এখনো হয়নি। এখনো মাঝে মাঝেই অবাক হই যে বাবা নেই। চাইলেই আমি তাকে জরিয়ে ধরতে পারবো না। ফোন করে বলতে পারবো না “বাবা এই শব্দটার synonym যেন কি?” সত্যি বলতে কি আমি বোধ হয় ব্যপারটাতে কখনই অভ্যস্ত হতে পারবো না। কোনসন্তানই হয়তো পারেনা। তবে পারতে হয় – মানিয়ে নিতে হয় – একটু ভাল ভাবে বেচে থাকার জন্য। অনেক বার ভেবেছি এই লেখাটা জমা দেবার থেকে পিছপা হব। তারপর মনে হয়েছে বাবার জন্য আমার লিখতে পারতে হবে। বাবা খুশি হত।
আমার বাবা – আলী যাকের। তাঁর কাছের মানুষের কাছে ছোটলু নামে পরিচিত । আমার দাদা ডাকতেন তনা। সেই তনা – বাবা, মা, ও দিদি হারিয়ে, খুব অল্প বয়সে একা হয়ে যাওয়া তনা, যে একদিন অসংখ্য মানুষের ভালবাসা ও শ্রদ্ধা পাবে তা কে জানতো? বাবা চলে যাবার পর আরও বেশি বুঝেছি বাবা কতজনের প্রাণের কাছের মানুষ ছিল। অসংখ্য ক্ষুদে বারতা, ফেসবুক স্ট্যাটাস ও লেখা পড়েছি, যেখানে প্রত্যেকে বাবার সাথে তাদের স্মৃতির কথা বলেছেন । সবার লেখা পড়ে একটা কথা আমার বার বার মনে হয়েছে – বাবার যার সাথেই পরিচয় হত তাঁর সাথেই সে খুব সহজ ভাবে কথা বলতে পারত, মিশতে পারতো। বাবার এই শিশু সুলভ সরলতার কারনে সে অনেকের মন জয় করেছে। আসলে বাবার ভালবাসতে পারার আর সেই ভালবাসা প্রকাশ করতে পারার দারুণ ক্ষমতা ছিল। কি ভাবে ভালবাসতে হয়, আদর করতে হয় সেটা আমি বাবার থেকেই শিখেছি। বুকে জরিয়ে আদর করা, গাল ধরে চুমা দেয়া ছিল বাবার আর আমার প্রায় প্রতিদিনের রুটিন। আমার মতে বাবার মত আদর আর কেউ করতে পারে না। আসলে আমার বাবা আমাকে যে ভাবে দেখত সেই ভাবে কেউ আমাকে দেখে না – বুঝেও না।বাবা আমাকে সব সময় মা বলে ডাকত। বাবার মুখে অনেক কেই বলতে শুনেছি “এই টা আমার মা । ১৯৬৪ – ১৯৮৪ – আমার মা চলে গেল ১৯৬৪ তে আর আমার এই মা এলো ১৯৮৪ তে”। আমার মা সব সময়ই বলে আমার জন্মের পর থেকেই বাবা আমাকে অন্য রকম ভাবে আদর করতো। অনেকেই হয়েত জানেন, বাবা ছবি তুলতে ভালবাসত আর আমার মতে বাবা অসাধারণ ছবি তুলত। তার তোলা ছবি তে যেন তাঁর ছবির মুল চরিত্র রা কথা বলে। আমার জন্মের পর থেকেই আমি আমার বাবার তোলা ছবির অনেকটা জুড়ে ছিলাম। অনেক ছবি আছে যেখানে বাবা আমার সেই বিষয় গুলো ধারণ করেছে যা অন্য কেউ হয়েত এড়িয়ে যেত বা খেয়ালি করত না। অনেক ব্যাস্ত ছবির মাঝেও আমি হয়তো এক কোনা দিয়ে বাবার সাথে টুকি খেলছি। বাবা তাঁর ছবি গুলোতে মানুষের মধ্যে যেই প্রাণ আছে, তাদের চোখে যেই গল্প গুলো লুকিয়ে আছে সেগুলো তুলে ধরতে পারতো। এইটা বাবার একটা বিশেষত্ব ছিল।
সবাই বেক্তিত্ত আলী যাকের কে হয়তো ভালো করে চেনেন কিন্তু কিছু দিক থেকে বাবা খুবি প্রাইভেট ছিল । বাবার সাক্ষাতকার গুলোতে বাবা ব্যাক্তিগত জীবন নিয়ে খুব বেশি খোল মেলা ভাবে কথা বলত না। বাবার বেক্তিগত জীবনের বেশির ভাগ জুড়েই ছিল তাঁর পরিবার। বাবা, মা, দিদি, ভাই বোন দের নিয়ে ছোট বেলার জীবন নিয়ে স্মৃতি রোমন্থন করতে বাবা ভালবাসত। জীবনের শেষ সময়ে এসে বাবা প্রায় বলত “আমার বাবা নিশ্চয়ই খুশি হয়েছে আমি রতনপুর –আমাদের গ্রামের বাড়ি- ফিরে গিয়েছি”। রতনপুর বাবার মনের অনেক বড় একটা জায়গা জুড়ে ছিল। বাবা পরিবার এর সাথে সময় কাটাতে পছন্দ করতো। ছোট বেলা থেকেই বাবার প্রিয় কাজ ছিল আমাদের গাড়িতে চাপিয়ে ঘুরতে বের হয়ে যাওয়া। আমরা প্রতি বছর প্রায় ১২–১৪ ঘণ্টা ড্রাইভ করে কক্সবাজার এর সমুদ্র সৈকত দেখতে যেতাম। আর যেতে যেতে আমরা পূরণও দিনের আধুনিক গান শুনতাম – মানবেন্দ্র, হেমন্ত, শচীন ছিল আমাদের ভ্রমণসঙ্গী। জীবনের শেষের কিছু বছর বাবার বেড়ানোর প্রিয় জায়গা ছিল রতনপুর। প্রায়ই বলত “চল মা রতনপুর ঘুরে আসি”। ক্যান্সার এর পরিকল্পনা যাই থাকুক না কেন আমার বাবার ইচ্ছা গুলো শেষ পর্যন্ত তাঁর মধ্যে বেচে থাকার সাহস জুগিয়েছে। আমার দের বছরের ছেলে এয়ানকে সে বলত ‘ভাইয়া তুমি আমি এক সাথে রতনপুর গিয়ে মাছ ধরব’। হাসপাতালের বিছানায় শুয়েও রতনপুর যাবার পরিকল্পনা করছিল বাবা। এই প্যান্ডেমিক অনেক কিছু আমাদের থেকে কেড়ে নিয়েছে কিন্তু তাঁর পাশাপাশি আমাদের দিয়েছে বাবার সাথে কিছু অতুলনীয় সময়। গত প্রায় আট মাস ধরে বাবার পুরোটা জুড়ে ছিল তার পরিবার। বাবা সব সময়ই বলত “আমার নাতি, নাতনি, ছেলে, মেয়ে আমার আসে পাশে থাকলে আমার আর কি লাগে?”। আর এই অল্প সময় আমার বাবার কাছ থেকে যত ভালবাসা আর আদর এয়ান আর আমার ভাই এর মেয়ে মেহা পেয়েছে, তাঁর জন্য আমি সব সময়ই কৃতজ্ঞ থাকবো। বাবার জন্য আমাদের আরামটা বরাবরি খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমরা যেখানেই যাইনা কেন সব চাইতে ভালো জায়গায় রাখার চেষ্টা করত। কিছু খেতে ইচ্ছা হলে সেটার ব্যাবস্থা করত। আরামের কোন কমতি মনে হলে সেটার সমাধান করত। বলত ‘ডোন্ট ওয়ারী মা। আমি ব্যাবস্থা করছি’। মৃত্যুর কিছু দিন আগেও আমি যখন হাসপাতালে বাবাকে দেখতে যাই তখন ক্যান্সার তাঁর শরীরে ছড়িয়ে পড়ায় বাবা ব্যাথাএ কাতরাচ্ছিল আর সেই যন্ত্রণা কে নিয়ন্ত্রণে আনতে তাঁকে মরফিন দেয়া হচ্ছিল। রাত তখন প্রায়ে বারটা। নিজের এতো কষ্টের মাঝেও বাবা আমাকে জিজ্ঞেস করল ‘মা ঘুমাবে না? বাবা সব সময়ই এমন। আমার, আমাদের, ভালো থাকা তাঁর কাছে খুবি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। চার বছর আগে যখন বাবার ক্যান্সার ধরা পরে, তখন থেকে কখনওই বাবা আমাদের দুশ্চিন্তা করতে দেইনি। কখনই বাবার মুখে শুনিনি যে খুব কষ্ট হচ্ছে। বাবা যেই রাতের ভোর বেলায় চলে গেলো, আমি হাসপাতালে গিয়ে দেখালাম বাবার প্রচুর পরিমাণে অক্সিজেন নিতে হচ্ছে। নিশ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে । এমন অবস্থাতেও যখন আমি জিজ্ঞেস করলাম তাঁর বেশি কষ্ট হচ্ছে কি না তাঁর মুখে মৃদু স্বরে একি উত্তর শুনেছি – “না”। এই চার বছর বাবা ক্যান্সারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয়ের চেষ্টায়ে যেই সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে তা বর্ণনা করার ভাষা আমার নেই। আসলে আমার মনে হয় বাবার সব সামলে নেবার চেষ্টাই ছিল আমাদের কষ্ট হাল্কা করার চেষ্টা। আমরা যাতে ভয় না পাই। আমার মনে পড়ে যখন প্রথম বার ক্যান্সার ধরা পরে তখন, আবার তিন বছর পর যখন বাবার শরীরে লুকিয়ে থাকা ক্যান্সার আবার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, দুই বারি আমি ভেঙে পরি আর দুবারি বাবা আমার মধ্যে সাহস যোগায় আর বলে “ডোন্ট ওয়ারী মা। আই উইল ফাইট দিস”। আমার বাবা ছিল আমার বট গাছ। আমার সাহসের উৎস। শেষের দিকে বাবার শারীরিক শক্তি অনেকটাই কমে গিয়েছিল– এমনকি বিছানা থেকে উঠে দু কদম হাটাটাও তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। কিন্তু এমন অবস্থাতেও তাঁর আমাদের মাঝে থাকাটা অন্য রকম একটা শক্তি যোগাত আমার মধ্যে– আমাদের মধ্যে। বাবা না থাকাতে অনেক বড় একটা ছায়া শরে গিয়েছে আমাদের মাথার ওপর থেকে যার বিশালতা আমরা এখনও পুরপুরি বুঝতে পারছিনা।
আমার বাবা আমার অজান্তেই আমাকে অনেক কিছু শিখিয়ে গিয়েছে। যেই মূল্যবোধ নিয়ে সে জীবন যাপন করেছে তা অনুসরণ করতে পারলে হয়তো আমি একজন ভালো মানুষ হতে পারবো। আমার বাবা ধর্ম, বর্ণ, সামাজিক বা অর্থনৈতিক অবস্থা নির্বিশেষে মানুষের সাথে মিশেছে। তাঁদেরকে ভালবেসেছে। গ্রামে সবার মাঝে বসে আগুণ পোহাতে পোহাতে আড্ডা দেয়া হোক কিংবা পাচ তারা হোটেলের লবি তে বসে কফি পান করা – বাবা দুটোই একই ভাবে উপভোগ করতো। আমার বাবা তাঁর নিজের নিতি এবং বিশ্বাসের ব্যাপারে ছিল কঠোর। তা নিয়ে কোন আপস করার যায়গা ছিলনা বাবার জীবনে। অভিনয়, কর্ম ক্ষেত্র এবং দেশের ব্যাপারে নিষ্ঠাবান হওয়াটা বাবার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। দেশ প্রেম আমার কাছে আমার বাবা। সে যেভাবে বাংলাদেশকে ভালোবাসতো আমি আর কাউকে এতো শর্তবিহীন ভাবে আমাদের দেশ কে ভালবাসতে দেখিনি। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ হোক বা আমাদের জাতীয় সঙ্গীত,শোনা মাত্রই বাবার চোখে জল আসতে বাধ্য। আমি এতো টুকুই আশা করি যে আমার বাবার দেশের প্রতি যেই ভালোবাসা ছিল কিছুটা হলেও যেন আমি আমার সন্তানকে তা বোঝাতে পারি, সেই প্রেম যেন আমি আমার এয়ান এর মধ্যে জাগ্রত করতে পারি।
বাবা কে নিয়ে কিছু লিখতে বা বলতে গেলে আজকাল আমার মনে হয় বাবার ব্যাপারে আমার যেই অনুভূতি সেটা প্রকাশ করার মত শব্দের ভাণ্ডার আমার কাছে নেই। আবার মাঝে মাঝে মনে হয় মহাকাশে যত তারা আছে তত গুলো শব্দও যদি আমার হাতের মুঠোয়ে থাকত তাহলেও আমি আমার জীবনে বাবার ভূমিকা ঠিক মত বর্ণনা করতে পারতাম না। এই বলে শেষ করব যে বাবা না থাকায় যেই শুন্যতা অনুভব করি তা কখনওই পূরণ হবে না কিন্তু আমি জেনে আর ভেবে শান্তি পাই যে বাবা আমার মাঝেই আছে। ছোট বেলায় যখন আমাকে কেউ বলত আমি দেখতে আমার বাবার মত তখন আমার একটু মন খারাপ হত। ভাবতাম যে হয়েত আমাকে বলা হচ্ছে আমি মার মত সুন্দরি না। কিন্তু বড় হয়ে বিশেষ করে বাবার চলে যাবার পর আমার খুশি লাগে এই ভেবে যে বাবার বোঁচা নাক আর গাল গুলো আমি পেয়েছি। বাবা যেন আমার মঝে আর আমার এয়ান আর মেহার মাঝেই আছে।
আমার আকাশের মত বিশাল বাবা – তুমি আমাকে যে ভাবে আগলে রেখেছিলে ঠিক একি ভাবে আমাকে স্বাধীনতাও দিয়েছিলে আর সেই স্বাধীনতা কে কি ভাবে শ্রদ্ধা করতে হয় সেটা শিখিয়েছিলে। আমার সর্বজয়া নাম টা তোমার দেয়া। তোমার দেয়া এই নমকে মর্যাদা দেয়াই হবে আমার বাকি জীবনের লক্ষ। অন্য কিছু জয় করতে পারি বা না পারি তুমি যেই ভাবে মানুষের মন জয় করেছ, সবার বিশ্বাস অর্জন করেছ আর ভাল মানুষ হবার চেষ্টা করেছ সব সময় – সেটা করার চেষ্টা আমি করে যাব । অনেক ভালবাসি আমার বাবা। অনেক বেশি।
শ্রিয়া সর্বজয়া